মানবজাতির প্রত্যেকের কর্তব্যের মধ্যে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবাযত্ন করা অন্যতম কর্তব্য। এটা ইসলামী সৌজন্যবোধের বিশেষ অঙ্গ। রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখার সময় তার রোগমুক্তির জন্য দু’আ করাও সুন্নত। অবশ্য সংক্রামক ব্যাধি, যেমন-বসন্ত, কলেরা, প্লেগ প্রভৃতির ক্ষেত্রে নিজ নিজ এলাকার জনগণের জন্য এ দায়িত্ব আদায় করা রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ। রোগী দর্শনকারীদের মঙ্গলের জন্য ফেরেশতাগণ আল্লাহর দরবারে সকালে ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা করে থাকেন।
সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় গুণ। কারণ ধর্যের ভিতর দিয়ে মনুষ্যত্বের পরীক্ষা হয়। বিশেষতঃ বিপদে ধৈর্যধারণ করা দুনিয়ার চাবিকাঠি। মহান আল্রাহ ধৈয্যশীলদের সঙ্গী। হযরত লুকমান তাঁর পুত্রকে উপদেশ দেওয়ার সময় বলেছেন- “তোমার উপর যে কোন বিপদ আসলে, তুমি তাতে ধৈর্যধারণ কর। এটি অতি মহৎ কাজ।” (সূরা লুকমান) মূলতঃ সবর বা ধৈর্যই সামাজিক জীবনে মানবিক বন্ধনকে স্থির রাখে এবং আত্মাকে বিশুদ্ধ করে আল্লাহ তা’লার নৈকট্যলাভে সহায়তা করে।
১. যখন কোন বান্দা অসুস্থ হয় তখন আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি ওহী নাযিল করেন, “আমি আমার বান্দাকে আমার জিন্দানসমূহের একটিতে বন্দী করেছি। অতঃপর যদি আমি তার প্রাণ হরণ করি, আমি তাকে ক্ষমা করব। আর যদি তাকে রোগমুক্ত করি, তবে যে এমন অবস্থায় উঠে বসবে যেন তার কোন পাপ নেই।” হাকেম ও তিবরানী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আবু উমামা (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
২. মুসলমানদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি যাকে দৈহিক বিপদের মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত করা হয় তার সম্পর্কে মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহ বান্দার আমল লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাকে ডেকে বলেন, প্রতিদিন ও প্রতিরাত এ বান্দার আমলনামায় যে পরিমাণ সাওয়াব লিখ যা সে সুস্থ অবস্থায় অর্জন করত এবং ততদিনই এমন করে যাও, যতদিন সে আমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। ইমাম আহমদ আলোচ্য হাদীসখানা আব্দুলাহ ইবনে উমর (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
[আলোচ্য হাদীস স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেছে যে, অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ বিশেষ সহানুভূতিশীল; এমন কি আল্লাহ তাকে সুস্থ অবস্থায় কৃতকর্মের সমপরিমাণ নেকী দান করে থাকেন, এটা তার দৈহিক ব্যাধির ক্ষতিপূরণস্বরূপ।]
৩. মহান আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি যখন আমার কোন বান্দার সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু দুটি চক্ষু হরণ করি, তারপর সে ধৈর্যধারণ করে এবং নেকীর আশা পোষণ করে, তাকে আমি বেহেশত ছাড়া অন্য কোন পুরস্কার দিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারি না।” তিবরানী ও হাকেম আলোচ্য হাদীসখানা আব্দুলাহ ইবনে আব্বাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
[কতিপয় হাদীসে অন্ধ মু’মিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর বিশেষ সহানুভূতির উল্লেখ রয়েছে। অন্ধ মু’মিনকে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত দান করবেন বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছেন।]
৪. হাদীসে কুদসীতে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যখন আমি আমার বান্দর দৃষ্টিশক্তি পৃথিবীতে হরণ করে লই, তখন তার পরিবর্তে আমার কাছে বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।” ইমাম তিরমিযী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আনাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
৫. মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহ বলেন, “আমার মু’মিন বান্দার জন্য আমার নিকট বেহেশত ছাড়া অন্য কোন প্রতিদান নেই যখন আমি দুনিয়াবাসীদের মধ্যে থেকে তার প্রিয়তম বন্ধুকে ছিনিয়ে নেই এবং তারপরও সে আমার প্রতি আস্থাবান থাকে।” ইমাম আহমদ ও বুখারী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
৬. মহান আল্লাহ বলেন, “আমি আমার কোন বান্দার প্রিয়তম বস্তু কেড়ে নেই না। কেড়ে নিলে তার প্রতিদান বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই আমার পছন্দনীয় নয়।” হযরত আবু নুয়াইম আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আনাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
৭. বরকতময় মহান আল্লাহ তা’আলা বলছেন, “যখন আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে কোন বান্দার প্রতি কোন বিপদ প্রেরণ করি তার দেহের ওপর অথবা তার সন্তানের ওপর অথবা তার সম্পদের ওপর, তারপরও সে উত্তম সবরের সাথে সে বিপদকে গ্রহণ করে, শেষ বিচারের দিন আমি লজ্জা অনুভব করি যে, কিরূপে তার জন্য দাঁড়িপালা স্থাপন করব এবং তার আমলনামা তার সামনে খুলে ধরব।” হাকেম ও তিরমিযী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আনাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
৮. নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শেষ বিচারের দিন বলবেন, “হে বনী আদম! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করনি।” বান্দা আরয করবে, “হে আমার প্রতিপালক! আমি কিরূপে আপনার রোগ সেবা করব, অথচ আপনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক?” তিনি বলবেন, “তুমি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জান না, যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে তুমি আমাকে তার নিকটেই পেতে।”
“হে বনী আদম! আমি তোমার নিকট খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাও নি।” বান্দা আবেদন করবে, “হে আমার প্রভু! কিরুপে আমি তোমাকে আহার করাব? তুমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক।” তিনি বলবেন, তোমার কি জানা নেই যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাও নি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে খাওয়াতে তবে তুমি তা আজ আমার কাছে পেতে।
“হে বনী আদম! আমি তোমার কাছে পানীয় চেয়েছিলাম, কিন্ত তুমি আমাকে পানীয় দাও নি।” বান্দা আবেদন করবে, “হে আমার প্রভু! আমি কিরূপে তোমাকে পান করাব, তুমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক।” তিনি বলবেন, “আমার অমুক বান্দা তোমার নিকট পানীয় চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পান করাও নি। তুমি যদি তাকে পানি পান করাতে, তবে আজ নিশ্চয়ই তা আমার কাছে পেতে।” ইমাম মুসলিম আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
৯. মহান আল্লাহ বলেন, “বিপদগ্রস্থদেরকে আমার আরশের নিকটবর্তী কর। নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে ভালোবাসি।” দায়লামী আলোচ্য হাদীসখানা কর্ণনা করেছেন।
১০. যখন কোন বান্দার সন্তান বৃত্যুবরণ করে, তখন আল্রাহ তার ফেরেশতাগণকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, “তামরা কি আমার বান্দার সন্তানদের প্রাণ নিয়েছ?” তারা বলেন, “হ্যাঁ!” তখন আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি তার অন্তরের ফুল ছিনিয়ে নিয়েছ?” তারা বলেন, “হ্যাঁ!” তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমার বান্দা কি বলেছিল?” তারা বলেন, যে তোমার প্রশংসা করেছিল (আলহামদুলিলাহ এবং ইন্নালিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তখন মহান আল্লাহ বলবেন, “আমার এ বান্দার জন্য বেহেশতে একখানা ঘর বানাও এবং তার নাম রাখ- ‘বাইতুল হামদ’(প্রশংসার ঘর)।” ইমাম তিরমিযী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আবূ মূসা (সা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
১১. নিশ্চয়ই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আদম সন্তানদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য দায়িত্বপ্পাপ্ত রয়েছেন। অতঃপর যখন কোন কাফির ব্যক্তি দু’আ করে তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে জিবরাঈল! তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দাও। আমি তার আহবান শুনতে চাই না।” আর যখন কোন মু’মিন বান্দা দু’আ করে তখন আর্লাহ বলেন, “হে জিবরাঈল! তার প্রয়োজন বন্ধ রাখ, কারণ আমি তার আহবান শুনতে ভালবাসি।” ইবনুন নাজ্জার আলোচ্য হাদীসখানা হযরত জাবির (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
১২. নিশ্চয়ই মু’মিন আল্লাহকে আহবান করে আর আল্লাহ তা’আলা তা পছন্দ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, “হে জিবরাঈল, আমার (মু’মিন) বান্দার এ প্রয়োজন মিটিয়ে দাও এবং তা স্থগিত রেখে পেছনে ফেল, কারণ আমি তার আওয়াজ শুনতে ভালবাসি।” আর নিশ্চয়ই (পাপী) ব্যক্তি আল্লাহকে আহবান করে কিন্তু আল্লাহ তা ঘূণা করেন। তারপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে জিবরাঈল! আমার বান্দার প্রয়োজন মিটিয়ে দাও এবং তা তার জন্য দ্রুত সমাধা কর। কারণ আমি তার আওয়াজ শুনতে পছন্দ করি না।” ইবনু আসাকির আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আনাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
১৩. কোন বান্দা যখন রোগাক্রান্ত হয়, তখন আল্লাহ তা’আলা তার নিকট দু’জন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এবং বলেন, “দেখ এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তি রাগে পরিদর্শকদেরকে কি বলে?” অতঃপর সে যদি তাদের প্রবেশকালে মহান আল্লাহর প্রশংসা করে তবে ফেরেশতাগণ তা আল্লহর নিকট নিয়ে যান। আর আল্লাহ তা জানেন। তখন আল্লাহ বলেন, “আমার বান্দার স্বপক্ষে আমার সিদ্ধান্ত এই যে, যদি আমি তার মৃত্যু ঘটাই তবে আমি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাব। আর যদি আমি তাকে রোগমুক্ত করি, তবে আমার দায়িত্ব ও বর্তব্য এই যে, আমি তার দেহের গোশত উত্তমতর গোশ্তে এবং তার রক্ত উত্তমতর রক্তে বদল করব এবং আমি তার পাপসমূহ মোচন করব।” দারু কুতনী হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর সূত্রে আলোচ্য হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন।
১৪. প্রত্যেক মানুষ যে তার কোন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে দেখতে যায়, তাকে জনৈক সম্বোধনকারী ফেরেশতা এ বলে আকাশ থেকে ডেকে বলেন যে, “তুমি সুখী হও এবং তোমার জন্য জান্নাত সুখের হোক।” মহান ও প্রতাপশালী আলাহ তখন তার আরশের ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, “এক বান্দা আমার উদ্দেশ্যে তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করেছে। সুতরাং তাকে দাওয়াত করে খাওয়াবার দায়িত্ব আমার ওপর; আর আল্লাহ তা’আলা তাঁর এ দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য বেহেশত ছাড়া অন্য কোন দাওয়াত পছন্দর করেন না।” আবু ইয়ালা আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আনাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
[আলোচ্য হাদীসটি রোগী দেখতে যাওয়া কিরূপ নেকীর কাজ এবং রোগীর সাক্ষাতকারীর প্রতি আল্লাহ তা’আলা কিরুপ সুপ্রসন্ন ও সদয় তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দান করেছেন। এ হককুল ইবাদ (বান্দার হক) পালনের পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করেছেন।]
১৫. মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহ নেককারদের রক্ষক ফেরেশতাগণের প্রতি এ ওহী প্রেরণ করেন, “দুঃখের অবস্থায় আমার বান্দার বিরুদ্ধে তোমরা কোন কিছু লিখিও না।” দয়ালামী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আলী (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
১৬. নেকীর ভান্ডার তিনটি- সদকা গোপন রাখা, মুসিবত গোপন রাখা এবং রোগের ব্যাপারে অভিযোগ গোপন রাখা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যখন আমি আমার বান্দাকে কোন বিপদ দ্বারা পরীক্ষা করি, তারপর সে ধৈর্যধারণ করে এবং আমার বিরুদ্ধে তার সাক্ষাতকারীদের নিকট কোন অভিযোগ করে না, তখন আমি তাকে বিপদমুক্ত করি এবং তার পূর্ববর্তী গোশত উত্তমতর গোশতে এবং তার পূর্ববর্তী রক্ত উত্তমতর রক্তে পরিবর্তন করে দেই। আর যদি তাকে ছেড়ে দেই, তবে তাকে এমনভাবে ছেড়ে দেই যে, তার কোন গুনহ থাকে না। আর যদি তার মৃত্যু ঘটাই, তবে আমার রহমতের দিকে তাকে টেনে নেই।” তিবরানী আলোচ্য হাদীসখানা হযরত আনাস (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
Leave a Reply